ঢাকা, শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁকে নিয়ে বিচারপতি সিনহার মিথ্যাচার 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৫৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৭:০৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শুভ জন্মদিন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’!

একাত্তরের শিশু এই আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছি আমার পরিবারের মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের অভিজ্ঞতায়, মায়ের মুখের গল্পে, সংবাদপত্রে আর বইয়ের পাতায় প্রকাশিত ছবি আর লেখনীর মাধ্যমে।

আবার কখনও বা চলচ্চিত্র, নাটক, গানের সুরে বা শিল্পীর তুলির আঁচড়ে– লাল-সবুজ পতাকার দিগন্ত বিস্তৃত ভালবাসার মায়ায়। কিন্তু এত কিছু জানার অনেক আগেই ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নাম, ৭ই মার্চের ভাষণ আর ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান ছিল আমার মনোজগতের খুব খুব পরিচিত অঙ্গনের একটি অংশ।

কিন্তু প্রায় চার বছর বয়সে হঠাৎ করে এক সকালে শুনলাম ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নামে আমার দেশের যিনি রাজা ছিলেন কারা যেন তাঁকে তাঁর পরিবারসহ গুলি করে মেরে ফেলেছে। লোকে বলা শুরু করল ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি এখন থেকে আর মুখে আনা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না।

কারন আর্মি রাজা নাকি জানতে পারলে ধরে নিয়ে যাবে। অতটুকু এক মেয়ে আমি কি আর এত কিছু বুঝি তখন? আর্মি  বলতে মা শিখিয়েছিল ‘পাকিস্তানীদের’ - যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা আমাদের দেশকে পেয়েছিলাম। বুঝতেই পারছিলাম না, এর মাঝে ওরা আবার কেন আমাদের দেশে ফিরে এলো, আর এসেই কি করে রাজা হয়ে গেল?

আরেকটি কথা শুনেছিলাম, ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ রাজার দুটি রাজকন্যা– শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা - বেঁচে আছে দুনিয়াতে কোথাও – তবে ওদেরকে নাকি দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঢুকলে নাকি আর্মি রাজা তাদেরকেও মেরে ফেলবে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে। তখন আমার বয়স নয় হয়ে গেছে। জানতে পারলাম ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ রাজার রাজকন্যা–শেখ হাসিনা নাকি দেশে ফিরেছে। তখনও দেশে আর্মি রাজা মানে সামরিক শাসন চলছে। ততদিনে আমি টেলিভিশন-রেডিও-মঞ্চে শিশু শিল্পী হিসেবে নিয়মিত গান গাই, আবৃত্তি, অভিনয় করি, উপস্থাপনা-বিতর্কও একটু-আধটু চলে। নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি আর অভিনয়ে জিতেছি প্রথম পুরস্কার।

শঙ্কর আন্তর্জাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পক্ষে জিতেছি রৌপ্য পদক। সব মিলিয়ে শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় একজন শিশু শিল্পী হিসেবে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে আমাকে ইন্টারন্যাশনাল পেন পলস ক্লাবের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি শিশু পুরস্কার’ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

বয়স তখনও আমার ১২ হয়নি। জানতে পারলাম পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আমার সেই ছোট কালের নাম শোনা রাজকন্যা শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি থাকবেন নারী নেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল।

আয়োজকরা আমাকে বললেন, পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি হবে ১৯৮৩ সালের ৩রা মার্চ শিল্পকলা একাডেমির খোলা মাঠে মঞ্চ করে। রাজকন্যা শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পর এটাই প্রথম কোনো জন অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেবেন। তবে আর্মি রাজার বিশেষ প্রহরীরা পাহারায় থাকবে যাতে সেই অনুষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক বক্তৃতা না দেওয়া হয়। আমি বরাবরই একটু ঘাড় তেরা প্রকৃতির। বললাম আমি তো ছোট মানুষ, আমার উপর নিয়ম কেন?

আমি অনুষ্ঠানে গানও গাইব না, আবৃত্তি বা একক অভিনয়ও করব না, দিলে বক্তৃতা-ই দেব। ইন্টারন্যাশনাল পেন পলস ক্লাবের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন চউধুরী আঙ্কেল ভাবলেন, ঠিক আছে, দু’চার কথা কি-ই বা আর বলবে এই পুঁচকে মেয়ে। তিনি রাজি হলেন। আমি তো মহাখুশি।

এক. রাজকন্যা শেখ হাসিনাকে নিজের চোখে কাছে থেকে দেখব; দুই. রাজকন্যা শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নেবো; তিন. আমার অতি চেনা কিন্তু না দেখা প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ কে নিয়ে বক্তৃতা দেব।

অবশেষে, ১৯৮৩ সালের ৩রা মার্চ দিনটি এলো । আমি তো অবাক, রাজকন্যা কোথায়? মঞ্চের উইংস থেকে দেখি প্রধান অতিথির আসনে বসে আছেন এক সাধারন নারী। হাল্কা ক্রিম রঙের জমিনে ছোট কালো প্রিন্টের সাধারন সুতি শাড়ি পড়া শীর্ণ কায়া এক নারী। বড় ফ্রেমের চশমা পড়া।

মুখে হাল্কা হাসির রেশ নিয়ে বসে আছেন। নিজের বক্তৃতায় দেশের কথা বললেন, নিজের বাবা বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’-এর কথা বললেন, স্বজন হারানোর কষ্টের কথা বললেন, আর বললেন দেশের মানুষকে তাঁর ভালবাসার কথা। যখন তাঁর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহন করলাম, তাঁকে আরও কাছে থেকে দেখার সুযোগ হল। হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ি। তেমন আর কথা হলো না।

এরপর শুরু হলো পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । মঞ্চ থেকে নেমে প্রধান ও বিশেষ অতিথিগণ দর্শকদের আসনের প্রথম সারিতে আসন গ্রহন করলেন। দুটি গান এবং একটি নৃত্যের পর পরই এলো আমার বক্তৃতা দেবার পালা। আমি কখন ও স্ক্রিপ্টে লেখা বক্তৃতা দেই নাই, এখন ও দেই না। তবে কথা বলার পয়েন্ট আগে থেকে সাজিয়ে রাখি। এগারো বছরের এক বালিকা তার বক্তৃতায় সেদিন সাড়ে পাঁচ মিনিট অনর্গল কথা বলে গেছে। 

আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, আমাকে বলেছিলেন উল্ট-পাল্টা কিছু না বলতে, বললে নাকি আর্মি রাজার প্রহরীরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে স্টেজের উপরে। মৃত্যুকে তখনও কাছে থেকে দেখিনি, তাই খুব একটা ভয় পাওয়ার কারণও ছিল না। মনে মনে ভাবলাম, মাইক যখন সামনে তখন ঠেকায় কে আমাকে? (এখনও আমি এমনটি-ই আছি, একটুও বদলাই নি, তবে কিছুটা কৌশলী হয়তো হয়েছি)।

এগারো বছরের সেই বালিকা আমি আমার বক্তৃতা শুরু করেছিলাম ‘জয় বাংলা’ বলে। কেউ শিখিয়ে দেয়নি, কিন্তু মন থেকে বলতে ইছহে হয়েছিল, যে দেখি এটা বললে কেউ গুলি চালায় কি না। না, গুলি চলেনি। বয়স কম দেখে হয়ত মাফ করে দিয়েছিল আর্মি রাজার প্রহরীরা। তো এক ধাপ সাহস বাড়ল। এর পর বললাম, আমার তিনটা প্রশ্ন আছে আপনাদের সবার কাছে। প্রথম প্রশ্ন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেন কথা বলতে পারব না? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ কে যে আমরা হত্যা করলাম সেটার জন্য জাতি হিসেবে কি আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ নয়? তৃতীয় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ আমাদেরকে এই দেশটা দিয়েছেন, কিন্তু আমরা তাকে কি দিয়েছি – অন্তত পক্ষে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি টুকু ত দিতে পারি তাই না? এর পরে এত জোরে দরশক রা তালি দিল যে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। গুম গুম আওয়াজ হচ্ছিল। আমি ভাবলাম হয়ত আমাকে আর্মি রাজার প্রহরীরা গুলি করছে। ভীষণ নার্ভাস হয়ে বোকার মত দাড়িয়েছিলাম। সম্বিত ফিরল যখন দেখি সামনের সারিতে বসা প্রধান অতিথি আর মাহবুব উদ্দিন চউধুরী আঙ্কেল নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে ইশারা করছেন না থেমে কথা বলে যেতে। একটু সামলে নিয়ে নিজের বক্তৃতা শেষ করলাম। আবারও ‘জয় বাংলা’ বলে মঞ্চ থেকে বিদায় নিলাম।

গ্রিন রুমে বসে থাকা অবস্থায় মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী আঙ্কেল আসলেন আর বললেন, চল তোমাকে হাসিনা আপা ডেকেছেন।’ আমি তো অবাক। তারপর দর্শকের সারিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি তো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বল। কি হতে চাও বড় হয়ে?’ সেদিন আমি যে উত্তর তাঁকে দিয়েছিলাম উনি হতভম্ব হয়ে গিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর উনার ব্যাগ থেকে ছোট একটা ডায়েরি বের করে তার একটু কাগজ ছিঁড়ে তাতে নিজের ফোন নাম্বার লিখে দিলেন আর বললেন তাঁর সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে দেখা করতে যেতে ফোন করে। আমি সেদিন কি উত্তর দিয়েছিলাম সেটা না হয় না-ই বললাম। কিন্তু সেই থেকে ‘রাজকন্যা শেখ হাসিনা’ আমার কাছে ‘শেখ হাসিনা আন্টি’ রুপে আবির্ভূত হলেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি আমার জন্য নিয়মিত যাতায়াতের জায়গাতে পরিণত হল।

‘শেখ হাসিনা আন্টি’ আমাকে অনেক বই পড়তে দিতেন। যখনি যেতাম তখন তিনি তাঁর দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বংবন্ধু, তাঁর দর্শন, তাঁর জীবনবোধ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সহ নানা বিশয়ে তাঁর আমাকে উপহার দেয়া বইগুলো এখনও আমার লাইব্রেরিতে সযতনে রাখা আছে।

সেই থেকে তাঁর পরামর্শে জীবন সাজানো, লেখা-পড়া এগিয়ে নেওয়া। ১৯৮৮ সালে যখন আমি কলাবিভাগে বাংলাদেশের চারটি শিক্ষা বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এইচএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করি তারপর তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে আমাকে ডেকে দলের সবার জন্য মিষটি কিনে এনে খাওয়ান। আর বলেন, পড়ালেখা তে কোন অবহেলা চলবে না। যেহেতু আমি পড়া লেখা করতে খুব আগ্রহী ছিলাম, তিনই বলতেন পড়া লেখাতেই যেন আমি মনযোগ দেই এবং তারপর আমার জ্ঞ্যান যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কাজে লাগাই।

২০০৫-এ পড়ালেখা শেষ করে যখন দেশে ফিরি তখন থেকে আমি যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে গবেষণাতে মনোনিবেশ করি। এরপর গণজাগরন আন্দোলনের ১৫ দিন পরই আমাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ প্রসিকিউশনের দায়ীত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হয়।

আমি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে অবস্থান নেয়ার পর আমার সেই ‘রাজকন্যা শেখ হাসিনা’ , ‘শেখ হাসিনা আন্টি’, ‘বড় আপা’ থেকে আমার জন্য ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ হয়ে ওঠেন। যুদ্ধাপরাধ বিচারের খাতিরে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’-র সাথে এর পর নিয়মিত যোগাযোগ হয়ে ওঠে – তবে কথপকথন চলে যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়েই। এই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে আমি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর সরাসরি সম্পৃক্ত আছি। তাই যখনি বাজারে প্রতিটী রায়ের আগে গুজব ছড়ানো হত সরকার নাকি যুদ্ধাপরাধ অপরাধীর সাথে আপোষ করে ফেলেছে আমি উতলা হয়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করতাম।

জানতে চাইতাম এমন কিছু কি হতে যাচ্ছে? ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ সেই আগের মতই হেসে বলতেন – তোমার কি আমার উপর আস্থা নেই? এসব নিয়ে কেন উতলা হও? তমাকে যে কাজ দিয়েছি সেটা শতভাগ আন্তরিকতা ও সততার সাথে করে যাও। আবার কখনও মজা করে অনুযোগ করতেন, “কি ব্যাপার, ব্যারিস্টার, মামলা শেষ করতে এত দিন লাগে কেন তোমাদের? কি আজকাল ঠিক মত পড়ালেখা করা হচ্ছেনা নাকি মামলা নিয়ে?”

আমি ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ কে দেখেছি যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়ে অটল থাকতে, আপোষহীন থাকতে। এমন মামলাও করেছি যেখানে বাজারে গুজব ছিল, একজন বিশেষ অপরাধীর ব্যাপারে নিশ্চই ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ নমনীয় থাকবেন। এই ব্যাপারে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’কে আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেন, ‘কোথা থেকে এসব গল্প পাও তোমরা? বিচার করছে ট্রাইব্যুনাল, তুমি দিচ্ছ আর্গুমেন্ট। আর আমি বাঁচাব আসামীকে? উল্টো বল যে কাজ ঠিক মত করছনা, তাই আমাকে নিয়ে এসব প্রশ্ন তুলছ?”

‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’কে দেখেছি ন্যায় বিচারের পক্ষে সোচ্চার থাকতে। তিনি স্বাধীন সার্ব ভৌম বাংলাদেশকে কখনো খাটো হতে দেননি আন্তর্জাতিক মোড়লদের হাতে অথবা দেশের ভিতরে চেতনা ব্যাবসায়িদের কাছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে কখনই তিনি যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়ান নি। জন কেরী, বান কি মুন, হিলারী লবি গ্রুপের চিঠি, ফোন কল বা চাপের মুখে হার মানেন নি। যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যেতে পারলে তাঁর সরকার আরও স্বস্তিতে দিনাতিপাত করতে পারতো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরন অন্যরকম হতেও পারতো । কিন্তু না, ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ সেটা হতে দেননি ।

অথচ আজকে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বই “ব্রোকেন ড্রিম” –এ উল্লেখ করেছেন যে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের সুপারিশ করতে  তিনি একবার ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সঙ্গে দেখা করতে চান। বিচারপতি সিনহা লিখেন –

“... I decided to approach the Prime Minister. Accordingly, I requested a meeting with the Prime Minister at a secret place. I got a favorable reply within few hours.”

অর্থাৎ বিচারপতি সিনহা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে দেখা করবেন। তো সেই উদ্দেশ্যে তিনি ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে একটি ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার জন্য অনুরোধ জানালেন। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তাঁকে সম্মতি জানানো হয়।

কী আশ্চর্য ব্যাপার! যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের সুপারিশ করতে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে দেখা করার জন্য বিচারপতি সিনহাকে একটি ‘গোপন জায়গাতে’ যেতে হবে কেন? সুপারিশগুলোর কথা তিনি নিজেই তাঁর বই-এ উল্লেখ করেছেন, এই যেমন, যুদ্ধাপরাধ বিচারে গতি সঞ্চার করার জন্য দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ, একই উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত বিচারপতি এবং প্রসিকিউটর নিয়োগের সুপারিশ, ইত্যাদি। এর সব কিছুই নাকি তৎকালীন আইন মন্ত্রী ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’কে সুপারিশ করেছিলেন কিন্তু ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ তাতে রাজী হন নাই বলে বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বই-এ উল্লেখ করেছেন। আর সে কারনেই নাকি তৎকালীন আইন মন্ত্রী বিচারপতি সিনহার শরণাপন্ন হন যেন বিচারপতি সিনহা নিজে একবার এই ব্যাপারে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’কে অনুরোধ করেন। সবই বুঝলাম, কিন্তু ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার বিষয়টি বোধগম্য হচ্ছেনা। ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’কে যেই প্রটোকল মেনে চলতে হয় সেখানে তিনি আদৌ কোন ‘গোপন জায়গাতে’ যেতে পারেন কিনা সন্দেহ। তাঁর উপরে একজন বিচারপতির সাথে দেখা করার জন্য তিনি প্রটোকল ভেঙ্গে ‘গোপন জায়গাতে’ দেখে করতে যাবেন সেটা আসলে কতখানি বিশ্বাস যোগ্য?

এরপর বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বই-এ উল্লেখ করেছেন ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে সেই তথাকথিত  ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার পর কি কি কথা হয়েছে। যেহেতু ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা হয়েছে, তাই বুঝে নিতে হবে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ এবং বিচারপতি সিনহার কথাবার্তার কোন সাক্ষী কিন্তু নেই! সেই গোপন সাক্ষাত কালে  ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ যদি কিছু বলে থাকেন তবে তার একমাত্র সাক্ষী হয়ে আছেন বিচারপতি সিনহা। তো সেই বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বই-এ এই ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন -

“When we met I told the Prime Minister the purpose of my meeting. The moment I raised the point, I felt she reacted sharply. Then she became emotional and explained to me the suffering she had undergone in getting justice for the trial of those who had murdered her parents and younger brothers. She told me how much money she spent for collecting and safeguarding witnesses and said the mental pressure she withstood was beyond comprehension. She was intensely interested in putting the offenders to justice, but she had to cross a lot of hurdles. Given that backdrop she straightaway rejected the proposal of the Ministers. She frankly conceded that corruption was rampant, and since the offenders were powerful persons having money and muscle, and they could influence any official or witness and this could not be tackled by the administration all the time. Moreover, forty years had elapsed in the meantime, and it was extremely difficult to collect witnesses as most of them are not alive now. She had set up the tribunal chiefly to meet her election pledge and there was nothing more than that she was prepared to do.”

অর্থাৎ যখন ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে দেখা হল তখন বিচারপতি সিনহা তাঁর দেখা করার উদ্দেশ্য ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’কে জানালেন। আর শোনা মাত্রই ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখালেন বলে বিচারপতি সিনহার মনে হল। (আচ্ছা খেয়াল করুন, এটা কিন্তু নিতান্তই বিচারপতি সিনহার মনে হওয়া ব্যাপার।) বিচারপতি সিনহা লিখেছেন ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ এরপর বললেন তিনি তাঁর পারিবারিক হত্যার বিচার করতে যেয়ে অনেক প্রতিকুলতার স্বীকার হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টি অনেক কষ্ট সাধ্য ব্যাপার, এর সফলতা নিয়ে তিনি সন্দিহান বিভিন্ন কারনে। তাই তিনি এই বিচার নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন। বিচারপতি সিনহার কাছে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ অকপটে বললেন যে তিনি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন মুলতঃ তাঁর নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, সুতরাং ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আর কিছু করার জন্য তিনি প্রস্তুত নন।

‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে বিচারপতি সিনহার এই কথা বার্তা থেকে সুস্পষ্ট ভাবে প্রমান হয় যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টি ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র কাছে যেন কোন গুরুত্বই রাখেনা। এটা শুধু একটা লোক দেখানো পদক্ষেপ সরকারের। সত্যি কি তাই? যদি সত্যি হয়েই থাকে তাহলে আমরা ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এত কাঠ খড় পোড়ালাম কেন? এত গুলো মামলার রায় হল কি করে? এরই মাঝে ৬টি ফাঁসী কার্যকর হল কি করে?

সরকার এত  বৈরী সহিংস পরিবেশ-এর মধ্য দিয়ে এই বিচার কে এগিয়ে নিয়ে গেল কেন? আন্তর্জাতিক বিশ্বে সরকারকে এত প্রতিকুলতা আর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হল কেন? 

যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র ভুমিকা নিয়ে বিচারপতি সিনহা যে জঘন্য মিথ্যাচার করেছেন তা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। আর সে জন্যই তিনি ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’র সাথে ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার বিষয়টির অবতারনা করেছেন।  এই আলাপচারিতার কোন সাক্ষী নেই। ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ আদৌ এ ধরনের কথা বলেননি বা বলতে পারেন না।  আমরা যারা যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিভিন্ন দায়ীত্বে রয়েছি তাহলে আমরা কাজ না করে বসে থাকলেও পারতাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, নানা সমালোচনার মোকাবিলা করেছি, নানা ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি।

উল্টো আমি দেখেছি বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করতে চেয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করতে চেয়েছেন। বিচার নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে নিজেকে শান্তি কমিটির সদস্য বলে দাবী করেছেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে পারেন নি। আর তাই তাঁর স্বপ্ন ভংগ হয়েছে। ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী’ কে নিয়ে মিথ্যাচার করে ভগ্ন স্বপ্নের অলিগলিতে নিজেকে সান্তনা দেবার বীজ বুনছেন।

কিন্তু আমরাও বীর বাঙ্গালী জাতি। বিচারপতি সিনহার মিথ্যাচার সইব না। আমরাও  জানি মিথ্যাচার আর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে। যুগে যুগে তাই করে এসেছি আর সামনেও তা-ই করব। জয় বাংলা!

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি